এক.
এমন অভিজ্ঞতা আমার জন্য নতুন কিছু নয়। পনের ডিসেম্বর শহীদ স্মৃতি পাঠাগারে সামনের অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করছিলাম কয়েকজন বন্ধু। স্বভাবতই আলোচনার মোড় ঘুরে গেল মুক্তিযুদ্ধের দিকে। তিনি এসেছিলেন এসময়েই। বেশ লম্বা-চওড়া, স্বাস্থ্যবান। আমাদের আলোচনার মধ্যে প্রাণপণে ঢুকে পড়তে চাইছিলেন। কেউই তেমন পাত্তা দিচ্ছিলাম না। হঠাৎ খেয়াল করলাম তিনি আসলে কি বলতে চাইছেন। তারপর টানা এক ঘন্টা মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনলাম একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে।
ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় প্রায়ই রাতের খাবার খেতাম ছাত্রাবাসের সামনের এক ছোট্ট হোটেলে। ঘরোয়া খাবারের স্বাদ পাওয়া যেত। হোটেল মালিক মোটাসোটা, ছোটখাটো আকৃতির- দাড়িওয়ালা ধর্মপ্রাণ মানুষ। গল্প করতে খুব পছন্দ করতেন। দুদিনের মধ্যেই তার পরিচয় জেনে গেলাম। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। রাতের খাবার শেষে বেশ কিছু সময় গল্প শুনে কাটিয়ে দিতাম। সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে গেল- পারিবারিক শত্রুতার জের ধরে তার এক আত্মীয় যখন থানার পুলিশ নিয়ে এসে তার উপর হামলে পড়ল; অসীম সাহসে পুলিশ বাহিনীকে সরাসরি মোকাবেলা করে বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম তাকে। তবু এবারের অভিজ্ঞতাটা একটু যেন অন্যরকম। বোঝানো যায় না এরকম কিছু একটা আছে মানুষটার মধ্যে। মিশুক ধরনের মানুষ আমি। যে কোন পরিবেশে চটজলদি মিশে যেতে পারি সবার সাথে। তুহিন যখন ওর চাচার কথা বলেছিল- তখন থেকেই দেখা করার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিলাম। তুহিন বারবার বলছিল ওর চাচা অন্যরকম। গায়ে মাখিনি। নিজের ওপর আস্থা বড্ড বেশীই আমার। এবার তাই জোরজার করেই ওদের বাড়িতে আসা।
মানুষটার মুখোমুখি হলাম সকালবেলা। রাতে যখন এসেছি- তিনি ঘুমুচ্ছিলেন। চৌচালা টিনের ঘর তুহিনদের। অবস্থাপন্ন সচ্ছল পরিবার। গ্রামের বাড়িগুলোতে সচরাচর যেমন সামনের রুমে সার বাধা কাঁচের ফ্রেমে 'ভুলনা আমায়' জাতীয় কাপড়ে সেলাই করা ছবি টাঙানো থাকে তেমন কিছু নেই দেখে শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠল ওদের রুচির প্রতি। ভেতরে প্লাই উডের দেয়াল লাগিয়ে ঘরে ডেকোরেশনে অন্যরকম এক আভিজাত্যের ছাপ। তাতে কয়েকটা দারুণ রুচিশীল পেন্টিং। এক পাশে দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়িটাও একেবারে বিল্ডিঙের সিঁড়ির মত করে তৈরি। সেরকমই দুই স্টেপে ঘোরানো। টার্নিং-এর মাঝখানে একটা ল্যান্ডিং- যথারীতি। সকালে তুহিনের ছোট বোন নাস্তা নিয়ে এলো। মিষ্টি মুখের এক কিশোরী। ভালোলাগার মত উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের মেয়ে। আর দারুণ উচ্চতা। গ্রামের মেয়ে অথচ কোন আলগা লজ্জা শরম নেই। শালীন পোশাকেই ঝকঝকে স্মার্ট লাগছে। মুখটুকু দেখলে বুকের কোন এক কোণে মৃদু কিন্তু বেশ শক্ত একটা ধাক্কা লাগে। কণ্ঠস্বর এত মিষ্টি যে মনের ভেতর বারবার প্রতিধ্বনি হতে থাকে। নিজের ওপর চোখ রাঙিয়ে থামিয়ে দেই। তুহিন অনেক দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
তিনি বসেছিলেন একটা হুইল চেয়ারে। চেয়ারটা যথেষ্ট দামী আর আরামদায়ক। ভদ্রলোক বেশ লম্বা। একটু কুঁচকে যাওয়া চামড়ার আড়ালেও তার উজ্জ্বল মসৃণ ত্বক ঢাকা পড়ে যায়নি। সুগঠিত কাঠামো। কিন্তু এসব আপাত বর্ণনার বাইরেও এমন কিছু একটা তার ভেতরে ছিল যেটাকে ঠিক বর্ণনা করে বোঝানো যায় না। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মুখ। তাকানোর পরে অদ্ভুত রকমের একটা দ্বৈত অনুভূতি হয়। প্রবল আকর্ষণে কাছে টানে আবার কেমন যেন শিরশিরে একটা ভয় ভয় ভাবও কাজ করে। স্ট্যাচু অব লিবার্টির মত একটা প্রবল সম্মানবোধের চাদর যেন আপাদমস্তক মুড়ে আছে তাঁকে। মুখোমুখি হতে নিজের অজান্তেই হাত তুলে সালাম দিলাম। স্পষ্ট উচ্চারণে সালামের উত্তর দিলেন, ভরাট পুরুষালী কণ্ঠস্বর। তুহিন পরিচয় করিয়ে দিল- 'আমার বন্ধু সাগর। এক সংগে পড়ি'।
'বসো সাগর।' গমগমে গলায় বললেন তিনি। কত রকম প্রশ্ন ছিল আমার। কিন্তু শুকিয়ে এলো গলা। হাঁটু থেকে তার একটা পা কাটা একথা কখনোই আমাকে বলেনি তুহিন। তবু এমন একজন মানুষের কাছেই কেমন যেন কুঁকড়ে জড়সড় হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল তিনি নন, আমিই পঙ্গু। আমার মত মানুষেরও এমন অবস্থা হয় তাহলে? আসলে বলা হয়নি তাঁর চোখ দুটোর কথাই। ভীষণ এক্সপ্রেসিভ আর অন্তর্ভেদী। তাকানোর পরে কেমন যেন নগ্ন লাগে নিজেকে। মনে হয় তিনি আমার সব রহস্য সমঝে গেছেন। এমনকি সকাল বেলা শিউলীকে দেখে আমার সদ্য জন্মানো অনুভূতিটুকুও।
'বন্ধুর সাথে বেড়াতে এসেছো? বাড়ি কোথায় তোমাদের?' প্রশ্ন শুনে নড়েচড়ে বসি। অকারণে গলা কেঁপে যায়। তারপর ধীরে ধীরে উত্তর দেই। তবু কিছুতেই বলতে পারি না তাঁর সংগে দেখা করতেই আসা। এক পর্যায়ে বললেন, 'এসেছো যখন ঘুরে ফিরে দেখ গ্রামটা। ভাল লাগবে তোমার।'
'জ্বি চাচা।' বলে কোনক্রমে পালিয়ে আসি সামনে থেকে। তুহিন আর আমি বাইরে আসি। বিশাল আম কাঁঠালের বাগান ওদের। জ্যৈষ্ঠের শুরু। গাছ থেকে সদ্য পাকা আম পেড়ে খাওয়ায় ও। দেশী আম- অথচ স্বাদ যেন জিভে লেগে থাকে। লোক ডাকিয়ে ডাব পেড়ে খাওয়ায়। আমরা ঘুরতে থাকি। মুগ্ধ চোখে দেখি চারদিক। খানিক হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে তুহিন, 'চাচাকে কিছু বলতে পারলি না তো?'
'নারে।' সদ্য খাওয়া ডাবের খোলটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে বলি, 'নারকেলের খোলের চেয়েও শক্ত ব্যক্তিত্ব।' হেসে ফেলে তুহিন, 'ভেতরটা কিন্তু ডাবের পানির চেয়েও তরল। তবে আমরা তার সন্ধান পাইনি কখনো। তোকে বোধ হয় বেশ পছন্দ করেছে।'
অবিশ্বাসের হাসি হেসে ধাক্কা মারি ওকে, 'আমার তা মনে হয় না।'
'না। সত্যিই মনে হয়। এত কথা কারো সাথে সচরাচর বলেন না উনি।'
'তাই নাকি?'
'হুম। একটু আশ্চর্যই হয়েছি।'
বোধ হয় তুহিনের কথা সত্যি প্রমাণ করতেই বিকেলে আবার ডাকলেন চাচা। শিউলীকে দেখলাম তার পাশে। তুহিনের কাছে শুনেছি, ওকে খুব পছন্দ করেন চাচা। আমাকে দেখে শিউলীকে বললেন, 'তুই গিয়ে কিছু নাশতা নিয়ে আয়। আমি এই হবু ইঞ্জিনিয়ারটির সাথে একটু আলাপ করি।' দুপুরে যতবার মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয়েছে কেমন একটা ভাললাগার শিহরণ বয়ে গেছে মনের মধ্যে। মনকে কঠিন শাসনে রাখতে তাই সহজে তাকাচ্ছি না ওর দিকে। শিউলী চলে যেতেই চাচা স্পষ্ট করে বললেন, 'শুনলাম তুমি আমার কাছে কিছু জানতে চাও?'
স্পষ্ট বুঝলাম, তুহিন সম্ভবত কিছু বলেছে শিউলীকে। তথ্যটা এভাবেই ফাঁস হয়েছে। কিন্তু শিউলীর নামটা মুখে আনতে গিয়েও আনলাম না। গলা কেঁপেটেপে গেলে চাচা সব বুঝে ফেলতে পারেন। নিরীহ গলায় বললাম, 'হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে?'
প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললেন, 'তুমি মন খুলে আমার সাথে কথা বলতে পার। কোন সমস্যা নেই।' আশ্বাস পেয়ে একটু ইতস্তত করেও বলেই ফেললাম, 'আসলে আপনার কথা অনেক শুনেছি তুহিনের কাছে। তাই যুদ্ধের গল্প শুনতে এসেছি।'
শুনেই কেমন যেন আনমনা আর গম্ভীর হয়ে গেলেন। চোখ যেন দিগন্তে সেঁটে আছে। মুখ দেখে ভয় ধরে গেল। শিউলী ফলের প্লেট নিয়ে চলে আসায় রক্ষে। নিজের অজান্তেই একবার চোখাচুখি হল ওর সাথে। সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের জন্য জমে গেলাম। চোখ ফিরিয়ে নেয়ার আগে শিউলীর রক্ত জমে যাওয়া মুখটা ছোট্ট একটা অনুভূতি জন্ম দিল। তাহলে কি ওরও? চাচা কিছু খেয়াল করেছেন বলে মনে হল না। শিউলীকে বললেন, 'তুই এখন যা। ওর সংগে একটু কথা বলি।' শিউলী বোধ হয় এই সুযোগটাই খুঁজছিল- আদেশ পেয়েই দ্রুত বেড়িয়ে গেল। আর আমি অপরাধবোধে ভুগতে ভুগতে মাথা নিচু করে প্লেট থেকে একটা টুকরা নিলাম। তাজা আম কাঁঠালের স্বাদই আলাদা।
দুই.
'সুমিত ছিল আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু।'
গল্প বলার মুডে চাচার কন্ঠ্য শুনে চমকে উঠেই মুখ তুললাম। 'সুমিত চক্রবর্তী। ব্রাহ্মণ হলেও ওদের পরিবারে আমার ছিল অবাধ যাতায়াত। ঐ সময়েও তারা সবাই প্রগতিশীল মানসিকতার ছিলেন। ধর্মীয় গোঁড়ামির ছিটেফোঁটাও ছিল না তাদের মধ্যে। সুমিত আর আমি ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী তখন। শোষণহীন সমাজ গড়ার স্বপ্নে বিভোর। দেশে তখন ব্যাপক ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল। উনসত্তরে ছয়দফা নিয়ে তুলকালাম। মতিউর আর আসাদের মৃত্যুর পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিমাদের জন্য তাজা ডিনামাইট হয়ে উঠছিল। তারা নিজেরাই সেই ইন্ধন দিচ্ছিল নানান রকম জেল আর জুলুমের মাধ্যমে। সত্তরের সাত ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের জয়ের পর থেকেই নানারকম তালবাহানায় সময় কাটিয়ে দিচ্ছিল ওরা। মার্চের শুরু থেকেই একটা উত্তাল সময় পার করছিল বাংলাদেশ। দুই মার্চ থেকে পাঁচদিন টানা হরতাল। সাতই মার্চের রেসকোর্সের মাঠে আমি আর সুমিত দুজনই ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর আহ্বান আমাদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। একটা তীব্র পরিবর্তনের গন্ধ আমাদের মাতাল করে তুলেছিল। আমাদের পরিবার আমাকে যথেষ্ট শাসন করলেও সুমিতদের পরিবার ছিল খুব উদার। তাই ওদের বাড়িতে বসেই আমরা দুজন বিভিন্ন পরিকল্পনা করতাম।'
'রাজনীতিতে তখন নানান গুজব ডালপালা মেলে যাচ্ছে। মাত্র আঠার দিনের ব্যবধানে পঁচিশ তারিখ রাতে আলোচনার নাম করে দেশে আর্মি লেলিয়ে দিল ইয়াহিয়া। আমাদের গ্রাম তখনো নিরাপদ। কিন্তু ঢাকার খবর শুনে হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে এলো সবার। খবর পেলাম গ্রামে গ্রামে আর্মি চলে আসছে শিগগীরই। সাতাশ তারিখ মেজর জিয়া চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণা পড়ে শোনান। সুমিত আর আমি দুজনই অস্থির হয়ে উঠলাম। আমাদের পার্টিতেও বিবিধ মেরুকরণ চলছে। কেউ যুদ্ধের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। উপায়ান্তর না দেখে বাড়ি থেকে পালিয়ে আমরা যুদ্ধে যোগ দেবার উপায় খুঁজতে লাগলাম। আমাদের গ্রামে আর্মি ঢুকল মে মাসের প্রথম দিকে। ব্যাপক গোলাগুলি, আগুন আর লুটপাটের খবর পেয়ে সেই রাতেই গ্রামে ফিরলাম। আমাদের পরিবারে সবাই ভাল আছে দেখে সুমিতদের বাড়ীর দিকে ছুটলাম। অবস্থা দেখে আমরা দুজনই বোবা হয়ে গেলাম।' বলতে বলতে চাচার চোখ দুটো চিকচিক করে উঠল। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর টের পেয়ে নিজেকে নিজেই তিরস্কার করলাম। এই বয়সে মানুষটাকে কষ্ট দেয়া খুব অন্যায় হয়ে গেছে।
হাল্কা করে বললাম। 'আপনার কষ্ট হচ্ছে চাচা। থাক না হয় তবে। আজ না হয় উঠি।'
চট করে আমার হাতটা ধরে ফেললেন চাচা। 'ক্ষতটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলেছ ইয়াং ম্যান। এখন এটা শেয়ার না করলেই বরং আমি একা একা কষ্ট পেতে থাকব। সেটা খুব ভাল হবে না।' বলতে বলতে একটু থেমে চাচা আবার বললেন, 'হুইল চেয়ারটা বাইরে নিয়ে চল তো একটু ঘুরতে ঘুরতে কথা বলি।' আমি তাঁকে বসিয়ে রেখে হুইল চেয়ার বাইরে নিয়ে গেলাম। আবার তাঁকে বেরোতে সাহায্য করলাম। সামনের বাঁধানো একটা পথ ধরে বাগানের দিকে পেছন থেকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চললাম। দুইপাশে নানান রকম পাতাবাহার আর ফুলগাছ। সকালে সুমিত দেখিয়েছিল একটা গাছের পাতা কেমন ফুলে গিয়ে বাটির মত হয়ে যায়। সেই পাতায় করে লবণ লংকা রেখে কাচা আম খাওয়ার মজাই নাকি আলাদা। আমি দেখতে দেখতে চেয়ার ঠেলছি আর চাচা তার কাহিনী শোনাতে থাকলেন।
'বীভৎস সে দৃশ্য সাগর। যে দেখবে সেই শিউরে উঠবে। বেয়োনেটের ঘায়ে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছেন সুমিতের বাবা মা আর মধ্যবয়স্কা কাজের মহিলা। একপাশে ছিন্নভিন্ন পোশাক নিয়ে প্রায় নগ্ন হয়ে পড়ে আছে সুমিতের বোন সৌ, সৌদামিনী। নিম্নাঙ্গে রক্ত জমাট বেধে আছে।' বলতে বলতে নিজেই শিউরে উঠলেন। 'সন্দেহ নেই উপর্যুপরি ধর্ষণ করা হয়েছে হতভাগা মেয়েটাকে। সারা শরীরে আগুন জ্বলে উঠল। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ভেতরে গিয়ে একটা কাপড় এনে ঢেকে দিলাম দেহটা। পাথর হয়ে পড়ে আছে সুমিত। বার বার ঝাঁকি দিচ্ছি তবু সাড়া পাচ্ছি না।'
তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে চাচা হঠাৎ বললেন, 'তুমি কখনো প্রেমে পড়েছ সাগর?' সত্যি বলতে কি, এই অদ্ভুত ব্যক্তিত্ববান মানুষটির কাছ থেকে আচমকা এ ধরনের প্রশ্ন ঠিক আশা করে উঠতে পারিনি। তবে কি তিনি ধরে ফেলেছেন, শিউলীর প্রতি আমার আকর্ষণ? ঝপ করে একরাশ রক্ত এসে নাক মুখ গরম করে তুলল আমার। ভাগ্যিস আমি তার পেছনে। তবে তিনি ঠিক সচেতনভাবে এসব বলছেন বলে মনে হল না। কারণ উত্তরের অপেক্ষা না করে আপন মনে কথাগুলো ক্রমাগত বলে যেতে লাগলেন। সব মানুষেরই কিছু দুর্বল সময় থাকে। অসম্ভব সৌভাগ্যবান হয়ে আমি এমন একজন মানুষের দুর্বল সময়ের সাক্ষী হতে চলছি।
'সৌ-এর প্রতি আমার আলাদা একটা বিশেষ অনুভূতি ছিল। ব্যাপারটা প্লেটোনিক ধাঁচেরই ছিল। কিন্তু দুপক্ষের ভাবগতিকই খুব সুবিধার ছিল না বলে সুমিত ব্যাপারটা আঁচ করে ফেলে। বেশ কিছুদিন নিজের মধ্যে চেপে রাখার পরে অবশেষে একদিন আমার কাছে প্রকাশ করেই ফেলে। মিথ্যা বলার অভ্যেস ঠিক ছিল না বলে আমতা আমতা করেও স্বীকার করে ফেলি। তবে এও জানাই। সৌ ব্যাপারটা জানে না। ওর বিশেষ কোন দোষ নেই। যদিও মনে মনে জানি কথাটা সত্যি নয়। কিছু ব্যাপার থাকে যা সোজাসুজি প্রকাশ করার দরকার পড়ে না। ওদের বাড়ীতে আমার জন্য সৌএর অস্থিরতা, অধিকার নিয়ে কিছু কাজ করার অন্য কোন অর্থ করা যায় না। যেমন সৌও বলতে পারে ওদের বাসায় গেলে আমার তৃষাতুর চোখ দুটো কাকে খুঁজত। কিংবা নিজেদের বাগান থেকে এটাসেটা নিয়ে গিয়ে বাসায় কার জন্য রেখে আসতাম। সে যুগে এগুলো অনেক বড় ব্যাপার ছিল হে। তোমাদের যুগের মত অনুভূতি পথ হারাবার সুযোগ খুব বেশী ছিল না।'
তিনি একটু দম নিলেন। 'আমার কথা শুনে সুমিত একটু বাঁকা হাসি দিল। আমার তো জানার কথা না, সুমিত সৌএর স্বীকারোক্তি আগেই আদায় করে নিয়েছিল।' সুমিত শুধু এটুকুই বলেছিল, 'আমার এসব ধর্মটর্ম নিয়ে মাথাব্যথা নেই তুই জানিস। বাবা মা কিছুটা আপত্তি করলেও একেবারে গো ধরে থাকবে সেরকমও মনে হয় না। কিন্তু তোর পরিবার কি তুই সামলাতে পারবি?'
'মোক্ষম প্রশ্নটা করে সুমিত আমার দিকে তাকিয়েছিল। আমার কাছে সত্যি কোন উত্তর ছিল না। কিছুদিন তাই আড়াল হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু থাকা সম্ভব হয়নি। বরং সুমিতের এই অনাহুত নাক গলানোটাই আমাদেরকে দ্বিতীয় ধাপে এগিয়ে দিয়েছিল। সুমিত আর কখনো কিছু বলেনি। আমার নৈতিক দিকটা ও ভালই জ্ঞাত ছিল।'
'সেরাতে সুমিত আর আমি কোনক্রমে লাশগুলো মাটিচাপা দিয়েই বেরিয়ে পড়ি। সীমানা পার হয়ে প্রশিক্ষণ শেষ করে এসে একটা গেরিলা দলে যোগ দেই। সেদিনের পর থেকে সুমিত কেমন যেন পাথরের তৈরি একটা যন্ত্রের মত হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে এমন সব ঝুঁকি নিত যা সুস্থ মাথার কেউ কল্পনাও করতে পারত না। শত্রুকে মুঠোয় পেলে স্রেফ একটা স্যাডিস্টের মত বেয়োনেট চার্জ করত। ওর অসীম সাহস আমাদের দলটাকে একটা ডেডলি গ্রুপে পরিণত করে। পাক সেনারা নাম শুনলেও আঁতকে উঠত। সুমিত মারা যায় ডিসেম্বরের তিন তারিখ। প্রতিপক্ষের একটা শেল ওর অবস্থানের উপর এসে পড়ে পুরো জায়গাটাই উড়িয়ে দেয়। আমরা জানতাম একদিন এমন কিছু একটা অবশ্যই ঘটবে। এতদিন যে হয়নি সেটাই ছিল একটা আশ্চর্য ঘটনা। কিন্তু ওকে থামানো যেত না। কেউ নিষেধ করলে এমন ভয় ধরানো ঠাণ্ডা চোখে তাকাত যে কেউ আর ওকে ঘাটাতে সাহস পেত না। তবু সুমিতের মৃত্যুর পরই অনেকদিন পর আমি কেঁদেছিলাম। আবেগের উত্তপ্ত জোয়ার এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল আমার এতদিনের জমানো দুঃখগুলো। পাঁচ তারিখের একটা অপারেশনে পায়ে গুলি লাগে আমার। তারপর থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে।'
তাঁর চোখে জল চিকচিক করতে লাগল। আমরা বাগান থেকে ধীরে ধীরে ফিরে আসি। তিনি আর কোন কথা বলেননি। আমিও আর ঘাটাইনি। এরপর আরো তিনদিন ছিলাম। এর মধ্যে আর চাচার মুখোমুখি হইনি। তিনিও কেমন যেন এড়িয়ে চলতেন আমাকে। তুহিনের মুখে শুনেছিলাম চাচা চিরকুমার। রহস্য ভেদ হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। তিনি কখনো আমাকে বলতে নিষেধ করেন নি। তবু আমারও কারো কাছে বলা হয়নি সেই অসম সামাজিক প্রেম রহস্য। প্রতিদিন সুমিতকে নিয়ে গ্রাম দেখতে বেরোতাম। সংগে প্রায়শ শিউলীও থাকত। চোরা চাউনি বিনিময় ঠিকই চলত। এ গাছ সে গাছ থেকে নানান রকম ফল পেড়ে আমার হাতে গোপনে গুজে দিয়ে তুমুল তৃপ্তি পেত ও। আমার কেবলই চাচার সাথে সৌদামিনীর প্রেম কাহিনী মনে পড়ে যেত। আচ্ছা সুমিত কাকার মত তুহিনও কি আমাদের ব্যাপারটা টের পাচ্ছে?
তিন.
চতুর্থ দিন সকালবেলা আমরা চলে আসি। তৃতীয় দিন বিকেলে শিউলীকে দিয়ে চাচা ডেকে পাঠান আমাকে। গম্ভীর মুখে কুশলাদি জানতে চান। আমার বাড়ীর খোঁজ-খবর নেন। বাবা কি করেন। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা- সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেন। কথা শুনে মনেই হচ্ছিল না কোন এক দুর্বল মুহূর্তে তিনি আমাকে তার জীবনের গোপনতম এক অধ্যায় শুনিয়েছিলেন। সেই প্রথম দিনের মত ব্যক্তিত্ববান গম্ভীর একটা মুখ। তারপর এক পর্যায়ে বলতে শুরু করেন।
'সাগর দেশটাকে আমরা বড় ভালবেসে স্বাধীন করেছিলাম। আজ চারদিকে এত অনৈক্য, বিভেদ, হানাহানি দেখে বড় কষ্ট পাই। যে শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম- তার কিছুই এদেশে আসেনি। একদল লুটেরার জায়গা দখল করেছে আর একদল লুটেরা। কৃষকের শ্রমিকের মুখে সেই একই আশাভঙ্গের ছবি। দূর্নীতি ক্যান্সারের মত ছড়িয়ে পড়েছে। তোমাদের প্রজন্ম অন্তত এই স্রোতে গা ভাসিও না। যত কষ্টই হোক, দেশের স্বার্থে লোভ সামলে রেখো। সাধ্যমত চেষ্টা কোরো দেশকে দূর্নীতিমুক্ত রাখতে। সাধ্যমত চেষ্টা কোরো ভুখা নাঙ্গা মানুষগুলোকে মানুষ করে তুলতে। আমরা তো কিছুই করে যেতে পারলাম না। তোমরা ব্যর্থ হয়ো না। তোমাদের প্রজন্মের উপরে আমাদের অনেক আশা।'
আমি এই প্রথমবার তার পায়ে হাত ছুঁয়ে কদমবুসি করলাম। 'দোয়া করবেন চাচা আপনাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার জন্য যেন আমাদের প্রজন্ম ঘুরে দাঁড়াতে পারি। আপনাদের যা করার তা আপনারা করে গেছেন। আমাদের জন্য স্বাধীন একটা ভূমি রেখে গেছেন। আমরাই ব্যর্থ হয়েছি সেই স্বাধীনতার ফসল তুলতে। দোয়া করবেন যেন আর একটা মুক্তিযুদ্ধ করতে পারি দেশকে লুটেরামুক্ত করতে। দূর্নীতি উপড়ে ফেলতে। আর নতুন উদ্যমে গড়ে তুলতে।' তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বির বির করে বললেন, 'আল্লাহ তোমাদের সহায় হোন। গড ব্লেস ইউ মাই চাইল্ড, গড ব্লেস ইউ।'
চার.
ছুটির দিনগুলোতে শাহবাগে ছবির হাটে নতুন পুরোনো কিছু বন্ধুরা মিলে সপরিবারে বিশাল একটা আড্ডা দেই। তুহিন এতদিন ঢাকার বাইরে ছিল। সম্প্রতি বদলী হয়ে এসেছে। সেও আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। চাকরীর পাশাপাশি আমরা একটা আন্দোলন করছি। দূর্নীতি, ক্ষুধা আর অশিক্ষামুক্ত প্রত্যয়ী বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলন। আশার কথা আমরা যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও অনেক বেশী সাড়া পেয়েছি। মানুষ সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে থাকতে চায় না। অল্প কিছু সংখ্যক খারাপ মানুষদের দাপটে অন্যরাও তাদের পথ অনুসরণ করতে বাধ্য হয়।
ভাল মানুষেরা সংঘবদ্ধ থাকে না। কিন্তু অল্প কিছু সংখ্যক দূর্নীতিবাজ দুষ্ট ক্ষতেরা একজোট হয়ে সমাজটাকে চালায়। ভাল মানুষগুলো আজ তা বুঝতে শিখেছে। তারা ক্রমেই এক হচ্ছে আর দুষ্ট মানুষগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। রাস্তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। নির্বিঘ্নে যাবে না জানি। মরিয়া হয়ে পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা চালাবে। কিন্তু ভয় না পেয়ে আমাদের এক হয়ে থাকতে হবে। শক্তি বাড়াতে হবে আরো। একদিন এই দেশটা হবে কিছু সৎ আর ভাল মানুষদের।
পার্কে এসে আমরা এসব নিয়ে আলোচনা করি। পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করি। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত সমমনা কিছু মানুষদের একটা সংগঠন। যাদের একটাই চাহিদা দূর্নীতি, ক্ষুধা আর অশিক্ষা মুক্ত প্রত্যয়ী বাংলাদেশ। যারা বিয়ে করেছি তারা সপরিবারে আসি। স্ত্রীদের বা স্বামীদের কেউ আলোচনায় যোগ দিতে চাইলে দেয় নয়ত তারা নিজেদের মত অন্য কাজে বা গল্প করতে ব্যস্ত থাকে। এসময় আমার দুবছরের পিচ্চি ছেলেটা দৌড়ে এসে আধো গলায় সিরিয়াস মুখভঙ্গী করে বলল, 'বাবা শোন। মা তোমাকে ডাকছে।'
আমি এগিয়ে যাই। অসম্ভব রকম দূরন্ত একটা ছেলে। কাজ শেষ করেই বিভিন্ন বয়সের আরো কিছু পিচ্চিদের সাথে খেলতে চলে গেল। আমরা দুজনই তার কান্ড-কীর্তিতে ভীষণ রকম মজা পাই। ও বলল, 'বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। পরশু যেতে হবে। তুমি কিন্তু ছুটি নিয়ে নেবে।'
আমি হাসি। 'ছুটি আগেই ম্যানেজ করে রেখেছি ম্যাডাম।'
'এই কেবল মাত্র ফোন এল আর তুমি আগেই ছুটি ম্যানেজ করে রাখলে কিভাবে?'
রহস্যময় ভঙ্গীতে আবৃত্তি করলাম। 'টু মাই ফাদার, আই ও মাই লাইফ। টু অ্যারিস্টেটল, হাউ টু লিভ ওয়ার্দিলী। হি ওয়াজ মাই ফাদার অব আইডিওলজি ম্যাডাম।'
প্রথমে বুঝে উঠতে পারলোনা কি বলেছি। ভ্রু কুচকে ভাবতে ভাবতে হঠাৎই মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর। তারপর বলল, 'সত্যি সত্যি তুমি দিনটাকে মনে করে রেখেছো?'
'কিভাবে ভুলি বল? এমন একজন মানুষের মৃত্যুবার্ষিকীর কথা ভুলে যাওয়া যায়? চাচা আমাকে অনেক সুন্দর একটা জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। আর সবচেয়ে বড় কথা তোমার আমার ব্যাপারটা তুহিন গাধাটা না বুঝলেও চাচাই কিভাবে যেন বুঝে ফেলেন। আর দুই পরিবারকে রাজী করিয়ে গোটা ব্যাপারটা একাই সামাল দেন।'
তুহিন কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারিনি। মাথায় গাট্টা মেরে বলল, 'বুঝতে পারিনি কে বলল। চাচার কাছে তো আমিই তুলেছিলাম ঘটনাটা। চাচা তার হৃদয়ের ক্ষত শুকাতে তোদের বিয়ে দিয়েছেন।'
'তার মানে তুইও চাচার ঘটনাটা জানিস?'
'জানবো না কেন গাধা। প্রেম আর ধোঁয়া কখনো চেপে রাখা যায়? কেউ চেপে রাখতে পারেনি। না লাইলি-মজনু, না বেনসন-হেজেস না আসিফ চৌধূরী আর সৌদামিনী। না একালের রোমিও জুলিয়েট সাগর-শিউলী।' লজ্জায় শিউলীর সুন্দর মুখটা লাল নীল বেগুনী হয়ে উঠতে থাকল। আর আমি মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি- প্রথম দেখার মতই। গাধা তুহীনটা কিছু না দেখার ভান করে দিনের বেলা আকাশের তারা গুণতে থাকে।
আমার মনে পড়ে গেল একটা প্রিয় কবিতা 'যোদ্ধা'র প্রিয় কিছু লাইন।
হুইল চেয়ারে বসা
আমার চাচা যখন যুদ্ধের গল্প বলতেন
অমোঘ উজ্জ্বল এক আগামীর প্রত্যয় মাখা চোখে
আমরা অবাক হয়ে তাকাতাম
পঙ্খীরাজে চড়ে আসা এক অদম্য
দিগ্বিজয়ী রাজপুত্রের দিকে
একটা পা ছাড়াই তখন তাকে নিখুঁত মনে হত।
০৩ মার্চ - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৫৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪